ছোটোবেলায় আমাদেরই এক বন্ধুর লেখা একটা কবিতা খুব নাড়া দিয়েছিল। কবিতাটায় দুটো লাইন বারবার ঘুরে ফিরে আসে। লাইন দুটো ছিল—‘দেশ কোথায়, বাড়ি কোথায়, দেশের বাড়ি?’ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে নিজের ভিতরে এই ‘দেশ’ বিবর্তিত হতে হতে কখন যেন ছিন্নমূল হয়ে গিয়েছে। একটা সময় পূর্বপাকিস্তান থেকে চলে আসা মানুষেরা, তার ওপরে নগরমুখী সভ্যতার প্রবাহে ভেসে আসা গ্রাম মফস্বলের মানুষেরা যে নিজেদের ছিন্নমূল মনে করত, নিজের দেশ অর্থে শিকড় ছেড়ে আসার অসহায়তায়, আজ তাদের কাছে ছিন্নমূল শব্দটার মানেই গিয়েছে পালিয়ে, যেমন ‘দেশ’ শব্দটাও যাবতীয় সংকীর্ণতা কাটিয়ে এখন অনেক ব্যাপক অনেক বিস্তৃত।
‘দেশ’ এখন আর পূর্বপুরুষের জন্মভিটে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কোনো বিশেষ জনপদ নয়, দেশ এখন সার্বিক অর্থে জন্মভূমি, ভৌগলিক বিস্তারই যার বিস্তৃতি। কিন্তু উপরে বর্ণিত কবিতার শব্দগুলো এই সময়েও যখন বিদ্ধ করে, তখন নিজেদের ছিন্নমূল মনে হওয়ার চাইতে দেশটাই যেন ছিন্নমূল হয়ে গিয়েছে এরকমটাই মনে হতে থাকে।
যে কোনো দেশেরই সংস্কৃতি থেকে ঐতিহ্য গড়ে ওঠে, আবার সেই গড়ে ওঠা ঐহিত্যই একসময় হয়ে ওঠে সংস্কৃতির বাহক। এইরকম একটা প্রবাহের মধ্যে থাকতে থাকতে একদিন যখন আবিষ্কার করি যে দেশে রয়েছি, তার ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি কোনো কিছুই আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পারছিনা, তখন দেশটাই ছিন্নমূল হয়ে গিয়েছে এইরকম মনে হতে থাকে। দেশ তখন আর দেশ থাকে না, দেশ তখন পর্যবসিত শুধুই রাজনৈতিক অস্তিত্বে।
পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশগুলোতেই দেখেছি যতই বিবাদ বা মতাদর্শগত পার্থক্য থাকুক না কেন, একটা বিষয়ে যাবতীয় মতপার্থক্য ঘুচিয়ে সবাই একজোট হয়, যখন সামগ্রিকভাবে দেশের বা দেশের মানুষের স্বার্থের প্রশ্ন উঠে আসে। সকল অন্তর্কলহ দূরে সরিয়ে দলমত নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়ায়। সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নির্বাচনে জয়ী দলকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেশ চালাবার অধিকার দেওয়া হয়, যা কখনো দেশের মালিকানা নয়। আর এই দেশ চালানোর ভূমিকাটা অনেকটা যৌথ সংসারের অভিভাবকের মতন, যিনি সংসারের সবাইকে সুরক্ষা দেবেন, তাদের ভালো মন্দের প্রতি নজর রাখবেন আবার সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রগতিতে হবেন মূল কান্ডারি, সংসারের সকলকে একসঙ্গে নিয়ে অন্তত আপাত পক্ষপাতিত্বহীন ভাবে। এই একসঙ্গে সকলকে নিয়ে চলতে পারাটা গণতন্ত্রের সংযুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রধান স্তম্ভ, যেমন প্রধান বৈশিষ্ট্য হল একে অপরের প্রতি যে কোনো অবস্থায়ই শ্রদ্ধা সংবেদনশীলতা বা সৌজন্য না হারানো। নির্বাচনে হারজিৎ হবেই কিন্তু একবার তা নির্ধারিত হয়ে গেলে সেটা মেনে নেওয়াই রীতি। যত নীতিগত, আদর্শগত পার্থক্য বা বিরোধীতা থাক না কেন কেউই এমন পদক্ষেপ নিতে চান না যাতে দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। দেশের স্বার্থ কখনো সরকার পক্ষের বা বিরোধী পক্ষের স্বতন্ত্র হতে পারে না।
এই নির্বাচিত সরকারই রাষ্ট্রের প্রতিনিধি যার হাতে থাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেশের শাসনভার। কিন্তু সরকার যদি নিজেকেই দেশ ভাবতে শুরু করে, অর্থাৎ নিজেকে নিজের চেয়েও বড় ভাবতে থাকে তখন শুভাশুভ বোধের ভারসাম্যের ব্যাঘাত ঘটে। এর ফলে মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়। মানুষের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে পরিবেশ, অভিজ্ঞতা আর শিক্ষা সঞ্জাত প্রজ্ঞার সমন্বয়ে। এই সমন্বয়ের ভিত্তি বিশ্বাস। সেটাই যখন নড়ে যায়, মূল্যবোধের আপোষ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকেনা। মূল্যবোধের আপোষ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীকেই দেয় পাল্টিয়ে, অনেক মিথ্যেকেও সত্যি বলে মনে হতে থাকে।
আর সেটাই এখন আমরা চারপাশে ঘটে যেতে দেখছি। সংযুক্তরাষ্ট্রিয় কাঠামোয় প্রতিহিংসার কোনো জায়গা নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাতো অনেকটা অগ্রজের, সব রাজ্যের প্রতি তার সমান পক্ষপাতিত্ব নাও থাকতে পারে, কিন্তু ঔদার্য বা সহমর্মীতার অভাব কেন হবে? প্রতিহিংসারতো প্রশ্নই নেই।
কিন্তু সেটাই যখন হতে দেখি, শ্রদ্ধা নেই, সৌজন্য নেই, ভাষা ব্যবহারে শালীনতা নেই, অক্লেশে মিথ্যে বলে যাবার ক্লান্তি নেই, তখন মনে হয় অনেককিছু নেই-এর মধ্যে কখন চির পরিচিত দেশটাও নেই, ছিন্নমূল হয়ে গিয়েছে। শুরুর কবিতার পংক্তি তখন সম্পূর্ণ বিপরীত তাৎপর্য নিয়ে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
কিন্তু কেন এমনটা হল? কখন থেকে আমাদের মুখ স্বচ্ছন্দ হতে শুরু করল মুখোশের আড়ালে? বৃহত্তর সমষ্টিগত স্বার্থের চেয়েও কখন জরুরী হয়ে উঠল ব্যক্তি স্বার্থ। রাষ্ট্রের আগে দল আবার দলের আগে ব্যক্তি। ব্যাপারটা এমন নয় যে আগে কোনো নেতৃস্থানীয় কেউ নিজের স্বার্থ দেখেননি, অবশ্যই দেখেছেন, কিন্তু পুরো বিষয়টা ঘটেছে অন্তত একটা আবরণের আড়ালে। কেননা মানুষের এই ধারণা বা বিশ্বাস ছিল যে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাদের কিছু সামাজিক দায়িত্ববোধও রয়ে গিয়েছে, যা অন্যথায় বিঘ্নিত হবে আবরণ সরে গেলে। এই আবরণটাই মানুষের সম্ভ্রম। সাম্প্রতিক সময় দেখা গেল রাজনীতির আঙিনায় সেই সম্ভ্রম বস্তুটি উধাও, কে কী বলল বা কে কী ভাবল তার কোনো প্রভাবই ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধিতে পড়ে না। শিষ্টাচার বা সংযম, ভাষার ব্যবহার কোনো কিছুই আমাদের শিক্ষা বা রুচি অনুযায়ী নয়, রণনীতি শুধুই ক্ষমতার প্রয়োগ। অথচ ক্ষমতারতো কোনো প্রকৃত প্রয়োগ হয় না, যা হয় সেটা অপপ্রয়োগই। আর ক্রমান্বয়ে অপপ্রয়োগ স্থিতিকে অস্থিরতা দেয়, শৌর্যকে শ্রীহীন করে, রুচিকে করে তোলে নিম্নগামী। নেতৃত্বস্থানীয়ের মাধ্যমে এটা ঘটে বলে এর প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে গ্রাস করে। আমরা জানতাম ঘুষ নেওয়া শুধু অপরাধই নয়, জানাজানি হলে লজ্জারও। খুব অবাক হয়েছিলাম কয়েক বছর আগে এক নামজাদা কর্পোরেটে একটি এম. বি. এ. করা অল্পবয়সী ছেলেকে দুঃখ করতে দেখে যে তার পুলিশ অফিসার বাবা একটা ভালো পোস্টিং পাচ্ছে না, কেননা তখন যে থানার তিনি ওসি সেখানে উপরি রোজগারের তেমন সুযোগ নেই। মনে হয়েছিল আমাদের অজান্তেই এই বদলটা ঘটে চলছিল বেশ কিছুদিন থেকেই। যারা সমাজে নেতৃস্থানীয়, সে রাজনৈতিক জায়গা থেকেই হোক অথবা সেই ব্যক্তির অবস্থানগত জায়গা থেকেই হোক তার বিশ্বাসের প্রভাব যাপনের প্রতিটা পদক্ষেপে, আর তা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এর ফলে আমাদের যাপন থেকে সরে গেছে সম্ভ্রম, সমষ্টিবোধ, সমষ্টি ভাবনা, বৃহত্তর ভাবনা। প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তাঁর আমন্ত্রণে রাইটার্স ইন রেসিডেন্সি’ প্রোগ্রামে রাইসিনা হিসল্এ সপ্তাহ দুয়েক থাকার সুযোগ হয়েছিল আরো কিছু ভারতীয় লেখক ও শিল্পীর সঙ্গে। একটা কথা তিনি বারবার বলতেন— লেখক শিল্পীরা সমাজের দর্পণ। প্রত্যেক রাজনীতিকের প্রতিদিন সময় বার করে অল্প হলেও শিল্প সাহিত্যের চর্চা করা উচিৎ। তাতে হৃদয় ও কল্পনার প্রসারতা বাড়ে। আমরা তখন সমাজের দর্পণে ঠিকঠাক নিজেদের দেখতে শিখি। কিন্তু এখন রাজনীতিকরা কেউ সাহিত্য পড়েনা। ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্কীর্ণতায় হারিয়ে যাচ্ছে রাজনীতির মহৎ তাৎপর্য দেশ। বর্ণিত কবিতার পংক্তি আবার অমোঘ হয়ে ওঠে।
১৯ পণ্ডিতিয়া টেরেস,
কলকাতা-২৯ যোগাযোগ-৯৮৩০০২৫৪৭৮/৮১৩০৭৯৭৭১৯