অবিশ্বাসের প্যানডেমিক

অনিশ্চিতি থেকেই কি অবিশ্বাস আসে, নাকি অবিশ্বাস থেকে অনিশ্চিতি? এক অদৃশ্য শক্র, যাকে চিহ্নিত করা গেছে, কিন্তু যাকে দেখা যায় না, যে অতর্কিতে ঢুকে পড়ে শরীরে, জানান দেয় বেশ কিছুদিন পর, তার ভয়ে এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবী জবুথবু। তার ভয়ে কেউই আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না, নিজেদের মধ্যেই সবাই সচেতনভাবে সৃষ্টি করছে দূরত্ব। কয়েকমাস আগেও কি মানুষ কল্পনাতেও ভাবতে পেরেছিল এরকম অদ্ভুত আঁধার এক নেমে আসবে পৃথিবীতে?

পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ অনেক বিপর্যয়ই পার করেছে, এটাও নিশ্চয়ই পার করবে। প্রাণরক্ষার দায়ে আমাদের যে গৃহবন্দী হয়ে থাকা, তার জন্য ব্যক্তিগত সকলের এবং দেশের যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় তাও কেটে যাবে একসময়ে সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। ও সহযোগীতায়। কিন্তু যে প্রশ্ন হয়ত অমীমাংসিতই থেকে যাবে, এই যে বিপর্যয় উদ্ভূত ভয়, তার থেকে আমরা নিষ্কৃতি পাব কি, পেলেও কী উপায়?

যে বিপর্যয়গুলো নিয়ে আমরা অধিক চিন্তিত, কথা বলছি সবসময়, বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে আলোচনা শুনছি, এ সবই বহির্যুদ্ধ। এর বাইরে আরো একটা বিপর্যয় ঘূণ ধরা আধুনিক স্বার্থসর্ব্বস্ব সমাজের ভিত্তিতে ক্রমশ পুরু হয়ে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তা হল অবিশ্বাস। যাকে দেখলে বুকে জড়িয়ে ধরতাম, তার কাছে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে থমকে যাচ্ছি। দুরত্বই এখন সুসম্পর্ক রাখার একমাত্র অবলম্বন। একটি কবিতায় পংক্তি মনে পড়ছে—‘নির্বাচিত দূরত্ব মেনে তবেই সঠিক সম্পর্ক রাখা যায়’। বেশ কিছু বছর আগে লেখা এই পংক্তিটি যে এমন অমোঘ হয়ে উঠবে, কবি নিজেও হয়ত ভাবেননি, তা কবিকে যতই ভবিষ্যদ্রষ্টা বলা হোক না কেন।

সমাজে সুশৃঙ্খলতা আনার জন্য যে বিধি নিষেধ, এই বিধি নিষেধই নিয়ে আসে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরণের নিশ্চয়তা, বিশ্বাস আর ভালো মন্দ বোধ। কিন্তু যখন এই বিশ্বাসের আস্তরণটা সরে যায়, জন্ম দেয় অবিশ্বাসের, তখন সভ্যতার মূল ভিত্তিটাই যেন সম্মুখীন হয় জিজ্ঞাসা চিহ্নের। জীবনযাপনের যে একঘেয়েমিতা থেকে নিষ্কৃতি পেতে মানুষ একসময় তৈরি করে নিয়েছিল বিনোদন, যে বিনোদন থেকেই এসেছিল সংস্কৃতি, সেই বিনোদন, সংস্কৃতিই তো এখন অস্তিত্ব রক্ষার সম্মুখীন। মানুষের মধ্যে থেকে যদি অবিশ্বাস না বার হয়, একে অপরের কাছে আসতে যদি সংশয় দ্বিধাই তীব্র হয়ে ওঠে, যা কেবলই বুনিয়াদ গড়ে দেবে দূরত্বের, তাহলে মানুষ একঘেঁয়েমির যাঁতাকলে পড়ে তো হয়ে উঠবে রোবট । আমি শঙ্কিত হই এই ভেবে যে এই অবিশ্বাস যদি মানুষ দূর করতে না পারে, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম প্রেম করবে কী করে, ভালোবাসবে কী করে, একে অপরের কাছেই আসবেই বা করে? না কি একটা যান্ত্রিক জীবনের দিকে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে এই অচেনা শক্র।

দৈনন্দিন জীবনে আমাদের বিনোদন বলতে ভ্রমণ (সে যেখানেই হোক), খেলাধুলো, আর সংস্কৃতি যার মধ্যে শিল্প, সিনেমা, থিয়েটার, সাহিত্য সবই পড়ে । এই সংস্কৃতির শুরু ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে মানুষের আগুন আবিষ্কারের কিছু আগে পরে সময় থেকে, যা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের সকল প্রকার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নানানভাবে বিবর্তিত ও বিস্তৃত হয়ে টিঁকে থেকে জানান দিয়েছে তার উপযোগীতা। করোনা নামক এই অচেনা শত্রুর দেওয়া অবিশ্বাস এখন আঘাত হানতে চলেছে সেই সংস্কৃতিতেই।

সারা দুনিয়াব্যাপী এই লকডাউনের সময় ফেসবুককে অবলম্বন করে যে যার মতন বেছে নিয়েছেন বিনোদন। অনেকে কবিতা পাঠ করছেন, কেউ গান গাইছেন, কেউ নেচেও দেখাচ্ছেন। বিশ্বনাথ আনন্দ এক অভিনব পদ্ধতিতে তার ভারতীয় সতীর্থদের নিয়ে দাবার আসর বসিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে অর্থসাহায্যও করেছেন। তার মানে কি এই যে ব্যক্তি আমরা বিনোদনের জন্যও নির্ভরশীল হয়ে পড়ব এই ভার্চুয়াল দুনিয়ার ওপর? কেননা আমরাতো এখন ভয় পাব। সব ক্ষেত্রেই ভয় পাব। মেলা মেশা করতে ভয় পাব, কাছে আসতে ভয় পাব। সংস্কৃতি মানে তো শুধুই আর্ট বা পার্ফরমিং আর্ট নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে জড়িয়ে থাকা যে আচার ও উপাচার, পূজো পার্বণ, পারিবারিক সম্মিলন, নানান অনুষ্ঠান এগুলোতে আমরা আগের মতই স্বতস্ফূর্ত হয়ে উঠতে পারব তো? নাকি এইসব ক্ষেত্রেও আমরা হয়ে উঠব ভার্চুয়াল, নির্ভর করব ভার্চুয়াল পৃথিবীর উপর?

যে লড়াইটা সরকারের করার কথা, সেটা সরকার করবেন। দেশের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, যাপনগত ভাবে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে নিয়ে আসা। কিন্তু যে লড়াই আমাদের নিজেদের করতে হবে, প্রত্যেককে একা একা নিজেদের মত করে, ফিরিয়ে আনতে হবে নিজেদের ভিতরের বিশ্বাস সমস্ত সন্দেহ দূর করে, সেই লড়াইটার জন্য আমরা প্রস্তুত হচ্ছি তো ? এই লড়াইয়ে আমাদের প্রধান শক্র আমাদের ভিতরকার ভয়, যে ভয়ই নিয়ে এসেছে অবিশ্বাস।

পরিচিত অনেকেই জানাচ্ছিলেন ডাক্তাররা কেউ কেউ ফোন ধরছেন না। এই সময় হঠাৎ কেউ করোনা ছাড়া অন্য কিছুতে অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখানো যাচ্ছে না। কিন্তু লকডাউন উঠে গেলেতো ডাক্তারবাবুদেরও রোগী দেখা শুরু করতে হবে, অসুস্থ মানুষকেও যেতে হবে তাঁদের কাছে। তখন কি বিশ্বাসের চেয়ে প্রয়োজনটা হয়ে উঠবে বড়? কিন্তু বিশ্বাসকে সরিয়ে রেখে প্রয়োজনকেই শুধু অবলম্বন করলে মানুষের সঙ্গে বাকি জীবজগতের পার্থক্য তাহলে আর থাকবে কোথায় ?

আমাদের এক একজনকে তাঁদের নিজেদের ভিতরের এই ভয়কে জয় করে অবিশ্বাসকে পার হয়ে বিশ্বাসে উপনীত হতে হবে তাঁদের নিজেদের মত করে । এই বিশ্বাসটা টানেলের শেষে আলো । এই সময়তো আমরা পার করছি বিভিন্নভাবে সাহিত্য পড়া, কবিতা, গান, সিনেমা এইসবের ভিতর দিয়ে । এই গৃহবন্দী জীবনে এগুলোইতো মানসিকভাবে সুস্থ থাকার উপাদান। এইগুলো আছে বলেইতো মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে সংস্কৃতি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, প্রসারিত করেছে মানুষের বিবর্তনের পরিসর। এইগুলোর ওপর নির্ভর করেই আমরা কি পারব না ভিতরের ভয়টা সরিয়ে মনের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে। পারতে তো হবেই আর সেটা যে যার মতন করে । ব্যক্তিগত স্তরে সকলের সামনে এখন এটাও এক অগ্নিপরীক্ষা।

প্রবালকুমার বসু
১৯ পণ্ডিতীয়া টেরস, কলকাতা-২৯
দূরভাষঃ ৯৮৩০০২৫৪৭৮/ ৮১৩০৭৯৭৭১৯

3 thoughts on “অবিশ্বাসের প্যানডেমিক”

  1. The very next time I read a blog, I hope that it wont disappoint me as much as this one. I mean, Yes, it was my choice to read through, however I genuinely believed you would have something interesting to talk about. All I hear is a bunch of crying about something you could fix if you werent too busy searching for attention.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *