পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও নেতার বান্ধবীর বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া অর্থ, সোনা ও সেই সূত্রে হদিশ পাওয়া সম্পত্তির পরিমাপে যেভাবে আমোদপ্রিয় বাঙালি সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ব্যক্তিগত বৃত্তে একই সঙ্গে বিস্মিত ও মুখর হয়ে উঠেছিল তাতে একটি প্রশ্ন না করার লোভ সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে৷ এতকাল কি তাহলে সকলে ঘুমিয়ে ছিলেন? মহামান্য ইডি এসে ঘুম না ভাঙালে আরো কতদিন ঘুমিয়ে থাকতেন তা কল্পনার অতীত৷ স্বভাবগত ঐতিহ্যে এরপরও নিশ্চয়ই শীঘ্রই সবাই আবার ঘুমিয়ে পড়বেন৷ তা না হলে এই যে একটা চূড়ান্ত অব্যবস্থা আর মূল্যবোধের প্রতিনিয়ত অবনমন চলছে প্রায় সব ক্ষেত্রেই, সেটা কি কারো চোখে পড়ে নি, না ইচ্ছাকৃত ভাবে মুখ ফিরিয়ে ছিল সকলে?
প্রতিবছরের মত এবছরেও রাজ অনুগ্রহে উপাধি বন্টন করা হল এ-সবের মধ্যে, একমাত্র অমর্ত্য সেন ছাড়া আর কারো মনে হল না, এই অবস্থায় রাজ অনুগ্রহ নেওয়া কতটা সমীচীন হবে! মনে হল না এই রাজ অনুগ্রহ আসলে আফিম, যা খাইয়ে সকলকে এক ধরণের চেতনাহীনতার মধ্যে পর্যবসিত করা হচ্ছে যাতে সকলেই শাসক দলের পক্ষ নেয়, ভুলে যায় প্রতিবাদ করতে৷ যেমন আমরা ইতিহাসের নানান কাহিনীতে পাই, সিংহাসন (ক্ষমতা) দখলের জন্য ছোটো ভাই বড় ভাইকে আফিম খাইয়ে বশ করে রাখছে৷ এও ক্ষমতা দখল রাখার এক পদ্ধতি৷ আর এই আফিম কখনো পরিবেশিত হয় অনুগ্রহের বল্কলে কখনো বা ধর্মের ছদ্মবেশে৷ এসব দেখে শুনেও, বুঝেও আমরা পাশ ফিরে ঘুমিয়ে থাকি, গভীর ঘুমে, যতক্ষণ না আবার নতুন কোনো কাহিনীর উদঘাটন হয় আর ঘুমের মধ্যে থেকে বিস্মিত হয়ে আমরা জেগে উঠি কিছুক্ষণের জন্য৷
ঘুমিয়ে থাকা মানে একপ্রকার মানিয়ে নেওয়া৷ বাঙালির চরিত্র এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে মেরুদন্ডটা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত৷ আমরা বিশ্বাস বা স্বীকার করি আর না-ই করি৷ বাঙালিদের প্রতি যে সম্ভ্রম অবঙ্গভাষি প্রদেশে ছিল, তা বহুদিন মুছে গিয়েছে, উপরন্তু এখন শুনতে হচ্ছে চোরের রাজত্ব৷ খুব কি প্রতিবাদ করতে পারি দিল্লিতে আমার হিন্দিভাষি সহকর্মী যখন একই প্রশ্ন করে? খবরের কাগজে পড়ি মফস্বল শহর বা গ্রাম লাগোয়া শহর গুলোতে কীভাবে ছোটো বড় মাঝারি নেতারা তাদের নেতৃত্বের মাপ অনুযায়ী বিগত কয়েক বছরে ফুলে ফেঁপে উঠেছে, পড়ার পরে আবার ভুলে যাই, ঘুমিয়ে পড়ি পাশ ফিরে শুয়ে৷ আমাদের চেতনায় তা কোনো আলোড়ন তোলে না৷ এইভাবে সমাজে যারা চিন্তক, যাদের দিকে সাধারণ মানুষ তাকিয়ে থাকে, তারা সুবিধাভোগী একটা শ্রেণীতে পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে, যে সুবিধার জন্য মান মর্যাদা খোয়াতেও তার পিছপা নয়৷ আমরা ছোটোবেলা থেকে পড়েছি বা জেনেছি আত্মমর্যাদাই বেঁচে থাকা সবচেয়ে বড় শক্তি, তার ক্ষয় মনুষত্বহীনতার সমতুল্য৷ যখন দেখি গত কয়েক দশকের রাজনৈতিক বিবর্তনে ছোটোবেলায় সেই পড়াশুনো বা জানাটা আর প্রযোজ্য নয়, তখন আমার মত ছ’য়ের দশকের আশেপাশে যাদের জন্ম, তাদেরও একই সঙ্গে শূন্যতা আর অবসাদ গ্রাস করে৷ কীভাবে সেটা ঘটল, তা সমাজ তাত্ত্বিকেদের গবেষণার বিষয়, কিন্তু যখন আপাত নানান মিডিয়া প্রচারিত পরিচিত মুখগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের নানান ক্রিয়াকর্মের জন্য ক্রমাগত ট্রোড হতে থাকে তখন বারবারই মনে হয় আত্মমর্যাদার কি কোনো মূল্যই নেই? তা না হলে কীসের লোভে কী পাবার আশায় মানুষ তাদের মূল্যবোধ এইভাবে বিসর্জন দেয়৷
রাজনীতি, অর্থাৎ যে নীতি ছিল রাজার, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে নিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর সেই নীতি নির্ধারণ যখন সাধারণ মানুষের আয়ত্ত্বাধীন হল তার নামটা তবু রয়ে গেল রাজনীতি৷ সেই রাজনীতি একসময় ছিল আদর্শগত৷ সংস্কৃতি জগতের অনেকেই সরাসরি যুক্ত থেকেছেন রাজনীতির সঙ্গে, কিন্তু তা পুরোটাই ছিল আদর্শের জায়গা থেকে৷ এমনও দেখা গিয়েছে কোথাও সেই আদর্শের সংঘাত হলে সেই ব্যক্তি সরে এসেছেন রাজনীতি থেকে অথবা বিকল্প কোনো কিছুর অনুসন্ধান করেছেন, যা তাঁর মতাদর্শের সঙ্গে অনেকটা মেলে৷ ভেঙে যাবার আগে বাঙালির মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারগুলোতেও একজন না একজন থাকতেন, তিনি কোনো না কোনোভাবে আদর্শগত রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে সামাজিক সংযোগ রক্ষা করতেন৷ এখন রাজনীতিতে আদর্শের আর কোনো জায়গা নেই৷ পুরোটাই ক্ষমতা ও অর্থের আকাঙ্খার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ কিন্তু প্রশ্ন হল এক শ্রেণীর আপাত (সিউডো) বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে, যারা সরকার পরিবেশিত আফিমে পরিপুষ্ট হয়ে গিয়ে নিজেদের প্রতিবাদকে প্রায় বন্ধক দিয়েছে, রেসের ঘোড়ার মত চোখে পড়ে নিয়েছে ঠুলি৷ একদিক ছাড়া বাকি কোনো কিছু তাদের নজরেই আসে না৷
এক প্রখ্যাত বর্ষিয়ান নাট্যব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা হচ্ছিল কিছুদিন আগে৷ প্রশ্ন ছিল বাঙালির এই দশা কেন? সিনেমা থিয়েটর রাজনীতি মেধা খেলাধুলো, প্রতিযোগিতা সব জায়গায় বাঙালির এই পিছিয়ে পড়া দশা কেন? একসময় যে অবজ্ঞায় আমরা উড়ে বা বিহারি এই শব্দগুলো ব্যবহার করতাম এখন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতি সেই একই অবজ্ঞা অন্যান্যদের চোখে৷ যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে অনুগামীকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হল যখন থেকে, বাঙালির বিপর্যয়ের সূচনার শুরু সেখান থেকেই৷ অধঃপতন শুরু হয় ধীরে, তারপর গতিপ্রাপ্তি হলে তাকে আর রোধ করা যায় না, ততক্ষণে সে হাতের বাইরে চলে গিয়েছে৷ সাধারণ মানুষ সবসময়ই সাধারণ, তাই তাদের প্রয়োজন হয় নেতৃত্বের৷ রাজনীতির জায়গায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের, সংস্কৃতির জায়গায় সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের৷ আর এই নেতৃত্ব কেউ ঠিক করে দেয় না, নেতৃত্ব আপনা থেকে তৈরি হয় ব্যক্তির আচরণ, কাজ, জীবনদর্শন থেকে৷ নেতৃত্ব যখন শুধু সুবিধার রাজনীতিকে আশ্রয় করে দাঁড়াতে চায় তখন সাধারণ মানুষেরও কিছু দায়িত্ব থাকে৷ তারাও যদি তাদের নেতাদের মত হয়ে ওঠেন, হারিয়ে ফেলেন শুভবুদ্ধি, তাহলে তাদের ঘুম ভাঙিয়ে জাগিয়ে তোলা খুবই দুষ্কর৷ তারচেয়ে আরো কিছুদিন তারা ঘুমিয়ে নিন, যাতে ঘুম যখন ভাঙবে, তারপর অনেকদিন অবধি জেগে থাকতে পারেন৷
যাপনচিত্র কুড়ি বছর পার করেছে৷ এই উপলক্ষে নানান অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে৷ বৃহৎ পরিকল্পনাও আছে৷ এসবেরই মধ্যে পূজো এসে গেল৷
সকলকে শারদ শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু হল যাপনচিত্র-এর ব্লগজিন যাত্রা৷ শুরু হউক৷
প্রবালকুমার বসু|